এই মুহুর্তে সব চেয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার৷ লঙ্কাপুরীতে পরিণত হয়েছে সব কিছু।অশান্তির আগুন পুড়ছে শ্রীলঙ্কা৷ পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর পৈতৃক বাড়ি জ্বলছে দাউ দাউ করে৷ প্রাণ বাঁচাতে নৌসেনা ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি ও তাঁর পরিবার৷ ইতিমধ্যেই শাসকদলের সাংসদ সহ পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ গোটা শ্রীলঙ্কা জুড়ে কার্ফু৷
গোটা দেশকে রসাতলে পাঠিয়ে অবশেষে ইস্তফা দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে৷ চরম অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে দেশ৷ জনগণের তীব্র রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে রাজনীতিবিদদের৷ অথচ এক সময় শ্রীলঙ্কায় জনগণের নয়নের মণি ছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে৷ এলটিটিই দমন করে বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন৷ সেই তিনিই এখন দেশবাসীর কাছে ভিলেন৷ কলম্বো জুড়ে বিদ্রোহের আগুন৷
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ‘টেম্পল ট্রি’র বাইরে দাঁড়ানো নিরাপত্তাবাহিনীর ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা৷ পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর যে প্রাণ বাঁচাতে কলম্বো থেকে হেলিকপ্টারে করে ২৭০ কিলোমিটার দূরে ত্রিনকোমালিতে নৌসেনা ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবার৷ রাজাপক্ষেকে নিয়ে তৈরি মিউজিয়াম ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷
শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, বিক্ষোভকারীদের নিশানা থেকে রেহাই পাননি ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারাও৷ সোমবার রাত থেকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের ৪১ জন শীর্ষ নেতার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ সরকার বিরোধী বিক্ষোভ কার্যত আগ্নেয়গিরির রূপ নিয়েছে৷ জ্বলছে রাজধানী৷ অশান্তি রুখতে জারি করা হয়েছে কার্ফু৷ সোমবার শাসকদলের সাংসদ অমরকীর্তি আথুকোরালার গাড়ি ঘিরে ধরে বিক্ষোভকারীরা৷
অভিযোগ, বিক্ষোভকারীদের সরাতে গুলি চালান সাংসদ৷ গুলি লেগে এক জনের মৃত্যু হয়৷ আহত হন দু’জন৷ কিন্তু সরকার বিরোধী উন্মত্ত জনতাকে এর পরেও পিছু হঠানো যায়নি৷ উল্টে তাঁরা ফের হামলা চালায়৷ পরে অমরকীর্তির গুলিবিদ্ধ দেহ উদ্ধার হয়৷ শ্রীলঙ্কা পুলিশের দাবি, ভয়ে আত্মহত্যা করেছেন সাংসদ৷ যদিও সেই দাবি নস্যাৎ করে রাজাপক্ষের দলের দাবি, তাঁকে খুন করা হয়েছে৷
গলা পর্যন্ত ঋণের দায়ে ডুবে রয়েছে শ্রীলঙ্কা৷ চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে নাগরিকদের৷ দুধ, ওষুধ, গ্যাস সিলিন্ডারের মতো অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের হাহাকার৷ সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে গিয়েছে খাবারের দাম৷ ১ কিলো চালের দাম ২০০ টাকার বেশি, ১ লিটার পেট্রোলের দাম ৩৩৫ টাকা৷ ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই দিনে ১২-১৩ ঘণ্টা ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকে শ্রীলঙ্কা৷
মারাত্মক দুর্নীতি, স্বজপোষন তো ছিলই, তার উপর জনমোহিনী নীতির জেরে দেখা দেয় রাজকোষে বিপুল ঘাটতি৷ স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সেই ক্ষোভই আছড়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কার রাস্তায়৷ এতদিন ভারতীয়দের কাছে শ্রীলঙ্কার প্রসঙ্গে উঠলেই ভিলেন হিসাবে উঠে আসত রাজীব গান্ধীর হত্যাকারী ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নাম৷ অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল অপরূপ প্রাকৃতির সৌন্দর্য, স্থাপত্যের সমারোহ৷ কিন্তু ঋণের জালে জর্জরিত প্রতিবেশী দ্বীপ রাষ্ট্রে এখন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি৷
কার্যত গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত এই দ্বীপ রাষ্ট্র৷ খাবার, নেই জল নেই, নেই জীবনদায়ী ওষুধ৷ পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের হাহাকার৷ এমনকী স্কুলে পরীক্ষার জন্য পেপারটুকুও নেই৷ এর নেপথ্য কারণ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সরকারের অদূরদর্শী নীতি৷ গত কয়েক বছরে বিদেশ থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার৷ একের পর এক মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে৷ সমুদ্র বন্দর, বিমান বন্দর, রাস্তা-ঘাট সহ নানা গালভরা প্রকল্প শুরু হয়েছে৷ বলা হয়েছিল শ্রীলঙ্কাকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়া হবে৷ কিন্তু বহু প্রকল্পই আর্থিকভাবে অলাভজনক প্রতিপন্ন হয়৷ বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পারেনি রাজাপক্ষে সরকার৷ উল্টে বেড়েছে ঋণের বোঝা৷
২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি হন গোতাবায়া রাজাপক্ষে৷ এর পর থেকে সস্তা জনপ্রিয়তা আদায় করতে তিনি একের পর এক জনমোহিনী নীতি কার্যকর করতে থাকেন৷ কমিয়ে দেওয়া হয় ভ্যাট ও ট্যাক্স৷ ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করা হয়৷ তুলে দেওয়া হয় ২ শতাংশ নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স৷ যার ফলে সরকারের কোষাগারে আয় কমতে থাকে হু হু করে৷
এই পরিস্থিতি হানা দেয় করোনা৷ ভেঙে পড়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ পর্যটন শিল্প৷ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ শ্রেয়া মৈত্রর কথায়, ওঁরা আসার পরেই করের হার কমিয়ে দেয়৷ খরচ চালাতে বিদেশ থেকে ঋণ নিতে শুরু করেন৷ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সেই ঋণ ফেরানোর পরিস্থিতি আর নেই৷ জাতীয় অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে৷
এদিকে, ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষে অর্গানিক কৃষি চালু করেন৷ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দ্রব্য আমদানি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়৷ যার ফলে ধান থেকে শুরু করে কফি উৎপাদন ব্যাপক ধাক্কা খায়৷ আয় কমতে থাকে মানুষের৷ বাড়তে থাকে খরচ৷ শ্রীলঙ্কার মানুষ বুঝতে পারেন দুই রাজাপক্ষে ভাই দেশকে কী ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে৷
অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কার আন্তর্জাতিক বন্দরের ৮৫ শতাংশ লিজ নিয়ে নিয়েছে চিন৷ শ্রীলঙ্কায় চিনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে সেতু থেকে বন্দর, রাস্তা তৈরি হচ্ছে৷ এটা ভারতের কাছে কতটা বিপজ্জনক? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিনের নীতিই হল ভারত মহাসাগরের আশেপাশে যত দেশ রয়েছে তাদের দিয়ে ভারতকে ঘিরে দেওয়া৷ সেই লক্ষ্যেই শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মায়ানমার এবং বাংলাদেশে চিনা পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে৷ শ্রীলঙ্কাও চিনের সেই ফাঁদে পা দিয়ে দেয়৷
শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, বাকি দেশগুলিকেও ঋণের ফাঁদে ফেলতে সফল চিন৷ তবে সম্প্রতি ভারত কিছুটা নড়েচড়ে বসে৷ উত্তর শ্রীলঙ্কায় দুটো ছোট দ্বীপে চিন পাওয়ার কমপ্লেক্স তৈরি করার জন্য টেন্ডার পেয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু, ভারতের দাবি মেনে সেখান থেকে তারা পিছিয়ে আসে৷ যদিও সেখানে ভারতের নাম নেওয়া হয়নি৷ বলে হয়েছিল, তৃতীয় পক্ষের প্রতিবাদে তারা পিছিয়ে এসেছে৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত এবং বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে অনুদানও দিয়েছে৷ কিন্তু চিন মেপে পা ফেলছে৷ অনুদান নয়, তারা শুধু চড়া সুদে ঋণ দিয়েই ক্ষান্ত৷