পাহাড় থেকে সমতলে নেমে হিং বিক্রি করতে এসে মিনির সঙ্গে ভাব জমিয়ে তোলা রহমত কাবুলিওয়ালার উত্তরাধিকারীই যেন তাঁরা

সে দু-এক দশক আগের কথা। রবিবারে রবিবারে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা আর কমলালেবু, ছোলা, শীতের রোদ পোহানো। বালুরঘাটে তখনও এত দোকান হয়নি। মলের তো প্রশ্নই ছিল না। বড়বাজারের কয়েকটি শুধু দোকান। কাশ্মীরের শালের ব্যবসা তাই জমজমাট। পাহাড়ি গ্রাম থেকে সংগ্রহ করে আনা রকমারি নকশাকাটা হাতে-বোনা সোয়েটার। কাজ করা রঙিন শাল, কম্বল নিয়ে এ পাড়া ও পাড়ায় ঘুরে ডাক ছেড়ে ফেরি করে বেড়ানো ফর্সা দাড়িওয়ালা কাশ্মীরিদের দেখলে কেমন যেন সেলুলয়েডের ছবি বিশ্বাসের কথা মনে পড়ে যেত। পাহাড় থেকে সমতলে নেমে হিং বিক্রি করতে এসে মিনির সঙ্গে ভাব জমিয়ে তোলা রহমত কাবুলিওয়ালার উত্তরাধিকারীই যেন তাঁরা। কিছুটা ভয়ের চোখেই তাঁদের দেখত তল্লাটের ছেলে-ছোকরারা।
গিটারের মোটা স্ট্রিংয়ের মতো ফ্যাঁসফ্যাঁসে ফাটা আওয়াজ অদ্ভুত এক যন্ত্র দিয়ে পিটিয়ে তুলোর মধ্যে থেকে তুলে আনত ধুনকর। বাড়ির খুদেরা আবদার ধরত, ‘মা আমার জন্যেও একটা লেপ বানিয়ে দাও না।’ কাশ্মীরি শালওয়ালা, বিহারি ধুনকর, আফগানি হিংওয়ালাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল উত্তরবঙ্গের প্রান্তশহর বালুরঘাটে। আত্রেয়ীপাড়ায় তাজা নদিয়ালি মাছের সঙ্গেই সঙ্গতে থাকত পাহাড়ি খাঁটি হিং দিয়ে তৈরি চালকুমড়ো, পালং শাক। সাদামাটা শীতের আনাজ, ডালের বড়ি গৃহস্থ বাড়িতে আটপৌরে হয়ে যেত কাশ্মিরীদের কল্যাণেই। ডাকবাংলোপাড়ায় ভাড়াঘর, জলযোগ মোড়ে সমরের চায়ের দোকানে সকালের নাস্তা। সে সবই ছিল শালওয়ালাদের ঠেক।
ডাকবাংলোপাড়ার এক অতিথিশালার ম্যানেজার এখনও নাকি শীতের ভোরে স্বপ্ন দেখেন, শাল-কম্বলের পসরা নিয়ে কাশ্মীর থেকে হাজির লম্বা দোহারা চেহারার লোকটা। ডাকছেন, ‘‘বাবু, দোর খোলো। হামি এসে গিয়্যাছে।’’ ছোট্ট একফালি থাকার জায়গায় ঢুকে অতিথিশালার ম্যানেজার ও কর্মীদের হাঁক দিয়ে এখন কেউ বলেন না, ‘‘বাবু, কেমোন আছো! ইবার যাদা দিন রেহেঙ্গে।’’ দিনবদলের তালে কোথায় যেন হারিয়ে গেল ওই মানুষগুলি। মিলিয়ে গেল হাঁক। মল, অনলাইনের বাজারে পরিযায়ী শব্দটাই বোধহয় ভীষণ বেমানান। সেই সময়ের শিশু-কিশোরেরা আজ কেউ বাবা, জ্যাঠা বা দাদু। শীতের দুপুরে পরের প্রজন্মকে দেওয়ার জন্য শালওয়ালাদের দু’-একটি গল্প ছাড়া তাঁদের ঝুলি শূন্য।