ভেল্লিকদম
প্রশান্ত কুমার রায়
স্কুলটির নাম খারিজা বিদ্যাপীঠ। পেছনে বিরাট বাঁশবন, তারপরেই ধল্লা নদী শ্বাসকষ্ট নিয়ে কোনও রকমে জীবন বয়ে চলে; বয়ে নিয়ে যায় এপারের স্পর্শ ওপারে; কাঁটাতার মনে মনে খুব রাগ করে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কাঁটাতার থেকে একশ মিটার দুরত্বে স্কুলটি কাঠা দশ জমির ওপর; চার চারখানা ক্লাসঘর; তারই একটি ঘর আকারে বড় থাকায় তিনভাগের একভাগ টিনের বেড়া দিয়ে অফিসঘর বানানো হয়েছে। একটি অঙ্গনওয়াড়ীর ঘর ও মিড-ডে মিলের জন্য চিড়িয়াখানার টিকিট ঘরের মত রান্নাঘর। এত কিছুর মধ্যে খেলার মাঠ শুরু হয়েই শেষ হয়ে যায়। এই স্কুলের শিক্ষক হরিৎ বর্মনের গাছ লাগানোর খুব শখ, কিন্তু উনি কখনোই উনি শখ বলতে রাজি নন। উনি বলেন, ‘গাছ লাগানো আমাদের সমাজের প্রত্যেকটি সামাজিকের প্রধান কর্তব্যগুলির মধ্যে একটি।’ উনি নিজ দায়িত্বে ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দিয়ে স্কুলের চারপাশে গাছ লাগিয়েছেন। সে কতরকমের গাছ – ফলের গাছ, ফুলের গাছ, সৌন্দর্যায়নের জন্য গাছ, বাদ যায়নি নিম গাছের মত ভেষজ গাছও। প্রকৃতির নিয়ম মেনে যে গাছগুলি এমনিই গজায় সেগুলিকেও যত্ন করে বড় করে তুলেছেন, এর জন্য অবশ্য তার সতীর্থদের কাছে অনেক ব্যাঙ্গাত্মক কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। সুযোগ পেলেই হরিৎ গাছ ও মানুষের সম্পর্কের কথা বলেন, এই তো সেদিন স্কুলের বিহারী শিক্ষক হাতের তালুতে খৈনি ডলতে ডলতে বলছিলেন ‘মাষ্টার মশায়, আমার নতুন বাড়ির ছকটা কিছুতেই করে উঠতে পারছি না।’ এই শুনে হরিৎ প্রথমেই বললেন, ‘বাড়ি করছেন সে তো ভাল খবর, কিন্তু একবার গাছের কথা ভাববেন। বাড়ির সামনে কিছুটা জায়গা বাগান করার জন্য রাখবেন। সেখানে আপনি পছন্দমত গাছ লাগাতে পারবেন। না হলে চারদিকে যে ভাবে ইমারত গড়ে উঠছে, আজ থেকে বছর দশেক পর দেখবেন মাইলের পর মাইল কোন গাছ নেই, সব শূন্য। একবার ভাবুন। গাছের সাথে আমাদের কি শুধু অক্সিজেন-কার্বন ডাই-অক্সাইড এর সম্পর্ক? গাছ আমাদের কত উপকারে লাগে, আমাদের পরম শান্তি, চোখের আরাম, মনের আরাম। একটু ভাবের ঘরে যান দেখবেন গাছই আপনার পরম আত্মীয়…।’ আরও অনেক কথা বললেন। বিহারী শিক্ষকের খৈনি হাতেই রয়ে গেছে, এত মনোযোগ দিয়েছিলেন যে খৈনি খেতে ভুলেই গিয়েছিলেন। শেষে হরিৎ নতুন বাড়ির জন্য সুন্দর একটি নক্সা তৈরি করে দিলেন, তাতে বাড়ির সামনে একটি বাগানও যোগ হল। এতে বিহারী শিক্ষক বেশ অভিভূত। এই কারণে আর সকলে ভদ্রলোককে বেশ পছন্দ করেন। কিন্তু তথাকথিত ‘সমাজিক মানুষ’ ওনাকে পাগল বলে। দেখলেই মুখ লুকোয়। অন্যদেরও বলে, কাছে যাস না। গেলেই গাছ লাগাতে বলবে। পাগল তো !
স্কুলের অঙ্গনওয়াড়ি ঘরের পাশেই এক প্রকান্ড পেঁপে গাছ। তারই ছত্রছায়ায় জন্ম নিয়েছে দুটি গাছ – একটি কদম, অন্যটি ভেল্লি। হরিৎ প্রথম থেকেই ওদের লক্ষ করে আসছিলেন। গাছের পুষ্টির কথা ভেবে তিনি সর্ষের খৈল জলে ভিজিয়ে বাসি করে সেই জল গাছের গোড়ায় দেন। ছাত্রছাত্রীরাও ওনার সাথে উৎসাহ নিয়ে গাছের যত্ন নিত। সেদিন এক ছাত্র কদম ও ভেল্লির দিকে দেখিয়ে বলল, “দা, এইল্লা গাছোতও পানি দেমো?” উনি বললেন “দে।” তারপর ভেল্লি ও কদমের কাছে গিয়ে বললেন, “তোদেরও বারুদ দিলাম। বিশ্ব উষ্ণায়ণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তোরাও তো দুজন সৈনিক…।” দিন যায় কদম বড় হয়, বড় হয় ভেল্লিও। ওদের মধ্যে বিনিময় হয় ভাবের, সূর্যের আলোর, জলের আরও কত কি… বর্ষা আসে। ওরা বর্ষার শীতলতা গ্রহণ করে পরিচিত অপরিচিত হাওয়ায় শরীর দোলায়। গেয়ে ওঠে এক সাথে বেঁচে থাকার গান। কিছু কিছু অনুভূতি ওদের মধ্যে সুন্দর ভাবে গড়ে ওঠে বিশ্বাস, বোঝাপড়া, ভালো লাগা, শ্রদ্ধা; আরও কত কি…
ওরা দুজনে ভাগ করে খেতে শিখেছে। হরিৎ বলেছিল কখনো একা খেতে নেই। সবাই মিলে ভাগ করে খেতে হয়। ওরা একসাথে পাতা বাড়িয়ে দেয় সূর্যের আলোর দিকে। এভাবেই ওরা একে অপরের ‘চিপকো’ হয়ে ওঠে। স্কুলের শিশুরা মান্দার গাছের ফুল হাতের নখে লাগিয়ে বড় বড় লাল নখ বানিয়ে খেলা করে। শিমুল গাছটাও বড় বড় লাল ফুল ফুটিয়েছে। আজ থেকে প্রায় চোদ্দ কোটি বছর আগে এই যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়েছিল প্রকৃতি, ফুল ফুটিয়েছিল গাছেরা নিজেদের অস্তিত্ব কায়েম রাখতে, সেটা আর একটা গল্প। বিকেল হলে সূর্য যখন গাঢ় লাল আভা ছড়ায়, হাওয়া দোলা দিয়ে যায় ভেল্লি কদমকে। হঠাৎই খেয়াল হয় এতো বসন্তের হাওয়া… কদম ভেল্লির দিকে তাকায় ভেল্লিও কদমের দিকে তাকায়। কদম বলে ওঠে –
-কিরে ?
-কী ?
-তোর চোখে আমি আমার মরণ দেখেছি। -মানে?
“তোর চোখে চোখ রাখলে যেন জলের ওপর সূর্যোদয়। তুই না বুঝিস বয়েই গেল; আমার চোখে সকাল হয়।” সাথে সাথে ভেল্লিও বলে ওঠে তোমার ছোঁয়া পেলে, আকাশ তবে আকাশ তোমার ছোঁয়া পেলে, মাটি তবেই তো সে মাটি।”
কিন্তু এই পর্ব বেশি দিন আর চলল না, ক্লাইম্যাক্সে এ ঢুকে পড়ে ভিলেনরূপী গ্রাম পঞ্চায়েত। ওনার আবার মানবিক স্নায়ুকোষ নেই। স্কুলে এসেই তদারকি করে দেখছিল চারপাশ, শেষে নজর গেল ভেল্লি-কদমের দিকে। বাণিজ্যিক বল্লম খোঁচা মারে মগজে। পঞ্চায়েত ভাবে, ভাবতে থাকে….। ভেল্লি ও কদমের কাছে এই লোকটা অপরিচিত ও বিদেশি। ওরা ভয় পায়। পঞ্চায়েত ভাবে, “ভেল্লির ফুল হয় না, ফলটাও কত বাজে দেখতে, কদম ফুল দেখতে সুন্দর, বড় হলে বিক্রিও ভালো হবে। তবে ভেল্লিকে কেন মিছিমিছি বড় করা? তবে কাটো।” একটুও দেরি হল না। দা-এর এক কোপে ভেল্লি শেষ। কদম স্বজন হারানোর বেদনায় ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিভাবে যে কদমের এই আর্তনাদ হরিৎ-এর বুকে কষ্টের অনুভূতি ঘটায়। হরিৎ যখন ভেল্লি কদমের কাছে পৌছয় তখন শুধু হাহাকার। নায়কের মত ঠিক সময়ে এন্ট্রি নিতে তিনি পারলেন না। বসে পড়লেন ভেল্লির পড়ে থাকা দেহের পাশে। কোলে তুলে নিলেন ভেল্লিকে, নীরবে চোখের জল ঝরালেন, হরিৎকে দেখে কদম তার সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললো-
মানুষ, তোমরা ভালোবাসতে জানো না। তোমরা দেখ সুন্দর রূপ; মন বোঝার শক্তি তোমাদের নেই, সব কি তোমরা ঠিক করে দেবে? আমাদের কি নিজের মত করে বাঁচার কোনও অধিকার নেই? কোনও কিছুই কি আমাদের মত করে হবে না ? সব তোমাদের ইচ্ছেয় …? তোমরা ভালোবাসতে শিখলে না এই আর্তনাদ হরিৎএর বুকে পৌছলেও পঞ্চায়েতের কাছে পৌঁছয় না। পঞ্চায়েত কেটে চলে আরো কিছু গাছ।
পুনশ্চঃ কিছুদিন পর কদম গাছটি শুকিয়ে মরে যায়।