কোভিডের এই মারণপ্যাঁচে ধুন্ধুমার চারিদিকে,ত্রাহি ত্রাহি রব। সবার মনে একটাই ভাবনা, নিস্তার কবে? এত দিন সবাই চাতকের মতো বসে ছিল, ভ্যাকসিনের আশায়। সে ভ্যাকসিন এল। কিন্তু তখন মানুষের মনে জাগল তা নিয়েও হাজার প্রশ্ন। তৈরি হল একাধিক ভ্যাকসিন মিথ। দেখে নেওয়া যাক, সেগুলি কী এবং আসল সত্যই বা কী।
১. ভ্যাকসিন সেফ নয় কারণ এগুলো এত তাড়াতাড়ি তৈরি হয়েছে।
উত্তরে বলে যায়, হ্যাঁ, তড়িঘড়ি তৈরি করতে হয়েছে কোভিড ভ্যাকসিন, ১ বছরের মধ্যে এবং আজ অবধি কোনও ভ্যাকসিনই এত কম সময়ে তৈরি হয়নি, এর আগের রেকর্ড ছিল মাম্প্স ভ্যাকসিনের, যা তৈরি হয়েছিল ৪ বছরে, কিন্তু তার মানে এই নয়, যে সুরক্ষাবিধিতে কোনও কম্প্রোমাইজ করা হয়েছে, বা এর জন্যে ভ্যাকসিনের কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। খেয়াল করতে হবে বিজ্ঞানীরা কিন্তু এই প্রথম SARS-CoV-2 নিয়ে কাজ করছিলেন না, অনেক দিন ধরেই করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা চলছিল। ফলে তাঁদের শূন্য থেকে শুরু করতে হয়নি। আরও ভেবে দেখুন, যে কোনও ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে অনেক ফান্ডিং লাগে, অনেকের কোলাবোরেশন লাগে, এ ক্ষেত্রে গোটা পৃথিবী কিন্তু একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে, ফলত কাজে প্রবল সুবিধেও হয়েছে। ক্লিনিকাল ট্রায়ালের ক্ষেত্রেও সমান্তরাল ভাবে কাজ করা গেছে, অর্থাৎ ওষুধ তৈরি হয়েছে, তা ট্রায়াল হয়েছে, যা কারেকশানের প্রয়োজন পড়েছে, তা তৎক্ষণাৎ হয়েছে, আবার ট্রায়াল…
২. কোভিড ভ্যাকসিন থেকে কোভিড হতে পারে…
কোভিড ভ্যাকসিন থেকে কারও কোভিড হতে পারে না। পারে না কারণ, কোনওটাতেই লাইভ ভাইরাস থাকে না। সাইড এফেক্ট যা হচ্ছে, মাথাব্যথা, জ্বর ইত্যাদি যাই হোক না কেন, তা ইনফেকশন নয়, ইমিউন রেসপন্স।
৩. ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অন্য কারও-কে ভ্যাকসিনপ্রাপক ইনফেক্ট করবে না
ভ্যাকসিন নিলেও বিজ্ঞানীদের মত, ভাইরাস ক্যারি করার সম্ভবনা থেকেও যেতে পারে। অতএব অন্য কেউ তা থেকে সংক্রমিতও হতে পারেন। ভ্যাকসিন ইনফেকশন আটকানোয় সাহায্য করে মাত্র। ফলে, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, স্যানিটাইজ করা নিয়ম মেনে এবং অবশ্যই দূরত্ববিধি মেনে চলা।
৪. এই ভ্যাকসিন আমাকে সারা জীবন সুরক্ষা দেবে
এখনও স্পষ্ট নয়, এই ইমিউনিটি কত দিন থাকবে, কারণ রোগটি সম্পর্কে এখনও বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ রূপে সব কিছু জেনে ফেলতে পারেননি। গবেষণা চলছে। ফলে এমনটা ভেবে নেওয়া ভুল হবে যে এক বার এই ভ্যাকসিন নিলে আর কোনও চিন্তা নেই।
৫. ভ্যাকসিন আমার DNA বদলে দেবে।
ফাইজার বা মোডার্না’র ভ্যাকসিন messenger RNA (mRNA) technology ব্যবহার করে, এগুলো সাধারণ ভ্যাকসিনের চেয়ে আলাদা। ক্লাসিকাল যে কোনও ভ্যাকসিন শরীরে ইনঅ্যাক্টিভেটেড প্যাথোজেন বা প্যাথোজেনের কিছুটা অংশকে সক্রিয় করে, এক রকম সিস্টেমকে শিক্ষা দেয়, কী ভাবে ইমিউন রেসপন্স তৈরি করতে হবে। mRNA vaccine কী করে, সে শরীরের সেল-কে ইন্সট্রাকশান দেয় কী ভাবে প্যাথোজেনের প্রোটিন নির্মাণ করা যায়। শরীর সে শিক্ষা পেয়ে গেলে, এক বার সে প্রোটিন তৈরি হয়ে গেলে ও শরীরে ইমিউন সিস্টেম আক্রমণ ঠেকাতে প্রস্তুত হয়ে গেলে, mRNA উবে যায়, দাঁড়িয়ে থাকে না আর, অতএব DNA-তেও কোনও এফেক্ট পড়ে না। এমনকী Mrna সেলের নিউক্লিয়াস অবধিও পৌঁছয় না, যেখানে DNA-র বাস।
৬. কোভিড ভ্যাকসিন মহিলাদের ইনফার্টাইল করে দেয়
এমন কোনও প্রমাণ নেই। প্রেগন্যান্সিতেও ব্যাঘাত ঘটবে বা কোনও বড় সমস্যা হবে, এমনও কোনও প্রমাণ নেই। গত বছর এমন একটি গুজব উঠেছিল বটে, যাতে বলা হয়েছিল, mRNA ব্যবহার করা ভ্যাকসিন দ্বারা কোড করা শরীরের স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে syncytin-1 নামের একটা প্রোটিনের যোগ আছে। এই প্রোটিনটি প্রেগন্যান্সির সময়, প্ল্যাসেন্টাকে ইউটেরাসের সঙ্গে জুড়ে থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু দেখা গেছে, দুটোয় কিছু অ্যামিনো অ্যাসিড এক হলেও, ইমিউন সিস্টেম মোটেই গুলিয়ে যায় না। অতএব এই ভ্যাকসিন ধরে নেওয়া যেতে পারে এ ক্ষেত্রে নিরাপদ।
৭. ভ্যাকসিনে এক রকম মাইক্রোচিপ রয়েছে
না, আদপেই না। অনেকের ভ্রান্ত ধারণা হয়েছে যে এই মাইক্রোচিপ দিয়ে এক দল অন্ধকারে থাকা এলিট, সব কিছু নিজের মুঠোয় নিয়ে নিতে উদ্যত। হাস্যকর ভাবনা বললেও কম বলে হবে। একে সত্য ভাববার কোনও ঘটনা এখনও ঘটেনি। এগুলো নিছকই কন্সপিরেসি থিয়োরি।